আজ- রাত ৩:২৫, বর্ষাকাল | শুক্রবার | ২১শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৫ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে জিলহজ, ১৪৪৫ হিজরি |
আজ- শুক্রবার, রাত ৩:২৫ | ৫ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Banner
Home » Blog » প্রত্যেক প্রবাসীই নিজ দেশের একজন অ্যাম্বাসেডর

প্রত্যেক প্রবাসীই নিজ দেশের একজন অ্যাম্বাসেডর

০ comment views
Social Share

প্রবাসে এসে নতুন বাসায় উঠেছি আমরা। একদিন সকালবেলা পাশের বাসার অজি (অস্ট্রেলিয়ানরা নিজেদের অজি ডাকে) প্রতিবেশী জন এসে হাজির। আমরা বললাম, ভেতরে আসো। আমাদের দেশের নিয়ম হচ্ছে প্রতিবেশীকে না খেয়ে যেতে দিতে বারণ বিশেষ করে প্রথমবার। সে একটু ইতস্তত করে বাসার ভেতরে আসলো।

আমরা জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী খেতে চাও। উত্তরে সে বলল, চা হলেই চলবে। আমরা চা বানিয়ে তাকে দিয়ে বসলাম গল্প করতে। জন কয়েক প্রজন্ম ধরেই অস্ট্রেলিয়ান। শুরুতেই জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কোন দেশ থেকে এসেছো। আমরা বললাম, বাংলাদেশ। এরপর সে যে প্রশ্ন করলো। আমরা মোটেও তার জন্য তৈরি ছিলাম না।

জন বলল, তোমরা কি অ্যাসাইলাম হিসাবে এসেছো? তার প্রশ্ন শুনে আমরা খুবই অবাক হলাম। আমরা পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তোমার এমন মনে হওয়ার কারণ কী? উত্তরে সে বলল, তার অভিজ্ঞতা থেকে সে এটা বলেছে। এরপর আমরা খুবই ঠান্ডা মাথায় তাকে বুঝিয়ে দিলাম, দিন বদলেছে। আমরা বললাম, আগে হয়তোবা এভাবে মানুষজন আসতো। কিন্তু তুমি জানো এখন ডিজিটাল যুগ।

তুমি শুনে অবাক হবে আমরা দেশ থেকেই পিআর নিয়ে এসেছি। তোমার অবগতির জন্য আরও জানাচ্ছি এখন অনেকেই এভাবে আসছে। অবশ্য ছাত্র হিসেবেও অনেকেই আসছেন এবং নিজের যোগ্যতায় এখানে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন। তোমার অবগতির জন্য আরো জানাচ্ছি, আমরা দুজনেই আমাদের পড়াশোনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চাকরিও করছি। এরপর থেকে জন আমাদের সমীহ করে কথা বলে।

আরেকদিনের কথা। রোজার মাস চলছে। আমাদের বাসার বিপরীতে রাস্তার অপরপাশের দ্বিতীয় বাসাটা এক বাংলাদেশি ভাইয়ের। উনি রমজান মাসকে সামনে রেখে বাসায় আলোকসজ্জা করেছেন। আর তার মধ্যে আলো দিয়ে আরবিতে ঈদ মোবারক লিখছেন। এটা দেখে আমাদের ঠিক বিপরীত পাশের বাসার মাইকেল আমাকে চেনে এবং জানি সেই প্রতিবেশীও বাংলাদেশি। তাই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, এগুলো কিসের সজ্জা।

আমি বললাম, তোমরা যেমন বড়দিনকে সামনে রেখে বাড়িঘর সাজাও আমরাও তেমনি এভাবে বাড়ি সাজাই। উত্তরে সে বলল, কিন্তু তোমরা তো বাসা সাজাওনি। আমি বললাম, তোমাদের মধ্যে কি সবাই তাদের বাড়ি সাজায়। এরপর প্রশ্ন করলো, তাহলে ঐ লেখাটা কিসের। আমি বললাম তোমরা সজ্জার মধ্যে বড় বড় করে ক্রিসমাস কথাটা লেখো না, এটাও ঠিক তেমন ঈদ মোবারক। সে বুঝতে পেরেছে এমনভাবে মাথা দোলাতে শুরু করলো।

অজিরা বেশিরভাগই বিশেষ করে প্রৌঢ়রা বাড়িতে কুকুর-বিড়াল পোষেন এবং নিয়ম করে সেগুলোকে রাস্তায় পার্কে হাঁটতে নিয়ে যান। এখানে কুকুরের জন্য আলাদা পার্কও আছে, আছে চিকিৎসা ব্যবস্থা। আসলে জীবকে এরা একটা জীব হিসেবেই চিন্তা করে এবং গুরুত্বও দেয়। আমরা যখন বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে পার্কে খেলতে বা হাঁটতে যাই তখন তাদের সাথে দেখা হয়।

আমরা বরাবরই সময় বুঝে একটা সম্বোধন করি যেমন, সকালবেলা হলে গুড মর্নিং, বিকালবেলা হলে গুড ইভিনিং। প্রতি উত্তরে তারাও হাসিমুখে সম্বোধন করেন। এরপর তাদের সঙ্গে থাকা কুকুরকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করি, হি অর শি। শুরুতে এভাবে জিজ্ঞেস করার ব্যাপারটা আমরা জানতাম না। আমরা সরাসরি কুকুরের নাম জানতে চাইতাম। পরে একদিন জানতে পারলাম আগে হি অর শি জিজ্ঞেস করে নিতে হয়। এরপর নাম জিজ্ঞেস করতে হয়।

কুকুর আমাদের ছেলেমেয়ে দুজনেরই ভীষণ পছন্দের প্রাণী। তারা কুকুর দেখলেই সেগুলোকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে ঠিক যেভাবে আমরা আমাদের বাসার পোষা কুকুরকে আদর করতাম। এরপর আমরা সেই কুকুরের নাম মনে রাখার চেষ্টা করি এবং পরেরবার তার নাম ধরে জিজ্ঞেস করি সে কেমন আছে। এভাবেই আমাদের অনেক বন্ধু তৈরি হয়ে গেছে। এরপর দেশের প্রসঙ্গ আসতেই বলি আমি বাংলাদেশের মানুষ।

অজিরা রাস্তাঘাটে চলার পথে অপরিচিত মানুষের সাথেও শুভেচ্ছা বিনিময় করে। সেটা দেখে আমিও তাদের শুভেচ্ছা জানাই। এভাবে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে টুকরো টুকরো কথাও হয়। যেমন সবচেয়ে বেশি কথা হয় আবহাওয়া নিয়ে। দিনটা কি রৌদ্রজ্জ্বল না কি ম্যাড়ম্যাড়ে, গরম না ঠান্ডা, তাপমাত্রা কেমন? এছাড়াও কেমন আছেন খুবই সাধারণ একটা প্রশ্ন।

এর উত্তরে আমি কখনওই অজিদের কোনো নেগেটিভ উত্তর দিতে শুনিনি। তারা বলে, এক্সেলেন্ট, ভেরি গুড আর যদি অবস্থা একটু বেগতিক হয় তাহলে নট টু ব্যাড, নো কমপ্লেইন এমনসব শব্দে উত্তর দেয়। এভাবে কত অপরিচিত মানুষ যে কি অকৃত্রিম হাসি উপহার দেয় তার হিসাব নেই। আমাদের স্টেশনে যতজন স্টেশন মাস্টার কাজ করেন আমি তাদের প্রত্যেককেই চিনি এবং ট্রেনে আসা যাওয়ার পথে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করি।

একইভাবে বাসের ড্রাইভারের সাথেও কুশল বিনিময় করা হয়। একদিন নতুন একজন নারী স্টেশন মাস্টারকে দেখে যথারীতি আমি গুড মর্নিং বলে সম্বোধন করলাম। উনি খুবই অবাক হয়ে, আমাকে বললেন লোকে সাধারণত আমাদের খোঁজ নেয় না। উত্তরে আমি বললাম, এখানকার সব স্টেশন মাস্টারকে আমি চিনি। একজন আছেন হেনরি, সম্প্রতি দাদা হয়েছেন বলে আমি তাকে দাদা বলে ডাকি। শুনে উনি হেসে কুটিকুটি।

বললেন, এরপরেরবার দেখা হলে তুমি ওকে পপস বলে সম্বোধন করবে। উত্তরে আমি বললাম নিশ্চয়ই। এরপর দেশের প্রসঙ্গ আসতেই আমি বললাম আমি বাংলাদেশের মানুষ। আমাদের অফিসে আমিই একমাত্র এশিয়ার। বাকিরা সবাই অজি এবং পৈতৃক সূত্রে আয়ারল্যান্ডের। চাকরির শুরুতে আয়ারল্যান্ডের মানুষদের নিয়ে তেমন ভালো কথা শুনিনি। কিন্তু এখানে যোগদানের পর আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে।

তবে তাদের কাছে বাংলাদেশের মনে হয় তেমন একটা ভালো ভাবমূর্তি ছিল না। তবে বিগত সাত বছরে আমি সেখানে একটা বড় ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছি। আমার বস বয়সে আমার বাবার বয়সী, একেবারে লাল টুকটুকে ফর্সা এক ভদ্রলোক। তাই আমাদের কোম্পানির মালিক দুই ভাইয়ের একজন আমাকে তার ছেলে বলে সম্বোধন করেন।

একদিন আমাকে ফটো কপিয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার বসের নাম নিয়ে আমাকে বললেন তোমার এই হাল কেন? মানে উনি তো ফর্সা কিন্তু আমিতো কালো। উত্তরে আমি বললাম, উনি আসলে ফটোকপিয়ারের অন্য দিক দিয়ে ঢুকেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সাদাকালো মুড অন থাকাতে এদিক দিয়ে আমি বেরিয়ে এসেছি। এরপর উনি যতজন নতুন মানুষ আমাদের অফিসে যোগ দিয়েছেন সবাইকে নিয়ে এসে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় এই গল্পটা বলেন। এই হলো বাংলাদেশের আলী, দাঁড়াও ওকে নিয়ে একটা গল্প বলি।

এই অফিসেই পরিচয় হলো আয়ারল্যান্ডের একজন তরুণের সঙ্গে। তার নাম মাইকেল মিকেলপ। বয়সে আমার ছোট কিন্তু উচ্চতায় আমার অনেক বড়। তার উচ্চতা ছয় ফুট নয় ইঞ্চি। তার পাশে দাঁড়ালে পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির এই আমাকেও লিলিপুট মনে হয়। সময়ের সাথে সাথে তার সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হলো। এরপর দেখি আমার এবং তার মানসিকতা খুবই কাছাকাছি।

আমরা দুজনেই একটা শ্রেণি বৈষম্যহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। আমরা একসাথে দুপুরের খাবার খেতে যাই। কোনোদিন আমি খাবার কিনি কোনোদিন সে খাবার কেনে। ঠিক যেভাবে আমরা ছোটবেলায় স্কুলে টিফিন ভাগ করে খেতাম তেমন। একদিন দেখি সে চে গুয়েভারার ভক্ত এবং তার চাবির রিং চে গুয়েভারার।

এরপর একটা সময় সে দেশে ফিরে গেলো এবং যাওয়ার সময় অনেক কিছুর সঙ্গে চাবির রিংটা আমাকে দিয়ে গেলো। ওরা ইচ্ছে করলেই যেকোনো সময় দেশে ফিরে যেতে পারে কিন্তু আমরা পারি না পাছে লোকে কি বলবে সেই ভয়ে।

অপেরা হাউস। পৃথিবী বিখ্যাত এক আশ্চর্যের নাম। সিডনির সার্কুলার কিয়ে স্টেশনে নামলেই যার দেখা মেলে। আর একটু পায়ে হেঁটে গেলেই চোখের সামনে সরাসরি দেখা যায়। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসেন বেড়াতে। তাই সার্কুলার কিয়ে স্টেশনের আশপাশে বেশকিছু মানুষ ভ্রাম্যমাণ কাজের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। একজন আছেন এক একদিন এক এক রকম সেজে মানুষের সঙ্গে ছবি তোলেন।

এরপর মানুষ খুশী হয়ে যা দেন তাই নেন। একদল উপজাতি আছে তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে চলেন। তাদের বাজনা শুনে খুশি হয়ে যে যা দেন তাই নেন। এর বাইরে অনেকেই আছেন। কেউ গিটার বাজিয়ে, কেউ বেহালা বাজিয়ে কেউবা কিবোর্ড বাজিয়ে দর্শনার্থীদের বিনোদন দেন। তার বিনিময়ে তারা যা দেন খুশি হয়ে নেন। এখানে আমার সাথে পরিচয় হয়েছিল আর্জেন্টিনার গ্যাব্রিয়েল গঞ্জালেজর। সে কিবোর্ড বজায়।

তার বাজনা শুনে খুশি হয়ে বললাম, আমি কফি নেব, তুমিও কি এক কাপ কফি চাও। উত্তরে সে বলল, তাহলে তো ভালোই হয়। কফি এনে আমরা গল্পজুড়ে দিলাম। এরপর সে আমার দেশ বাংলাদেশ শুনে বললো, তুমি আমাকে বাংলাদেশের কোনো একটা মিউজিক ইউটিউবে খুঁজে দাও যেটা আমি বাজাতে পারি। আমি সাথে সাথে তাকে মাহমুদুজ্জামানের ‘আমি বাংলার গান গায়’ খুঁজে বের করে দিলাম।

Leave a Comment

ফেইসবুক পেইজ

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহবুব হুসাইন; (B.Sc & M.S in Geology & Mining; Master’s in Mass Communication & Journalism From Rajshahi University)

অফিসঃ আশিক টাওয়ার ৩য় তালা, মুড়িপট্টি, সাহেব বাজার, রাজশাহী।
মোবাইলঃ +৮৮ ০১৭৪০-৮৭৬২৮৪
ইমেইলঃ mahabubgmining@gmail.com

তরুণ মাঝি পরিবার

নির্বাহী সম্পাদকঃ- রিজভী আহমেদ
বার্তা সম্পাদকঃ- আব্দুল অলিম রনি

যোগাযোগের ঠিকানা

প্রধান ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ

ললিতাহার, খড়খড়ী-৬২০৪, চন্দ্রিমা, রাজশাহী।
মোবাইল:- +৮৮ ০১৫১৫-২২৮০০৫
ইমেইলঃ torunmajhitv@gmail.com

উপদেষ্টা মন্ডলী

মোঃ মনিরুজ্জামান স্বাধীন
প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল ওয়াকিল

@ 2023 – All Right Reserved torunmajhi.com | Design & Developed by CBA IT