রাজশাহী নার্সিং কলেজের অধ্যক্ষের অপসারণ দাবিতে আবারো বিক্ষোভ করছে শিক্ষার্থীরা। গত রোববার ফেল করা গুটি কয়েক শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করলেও গতকাল সোমবার তাদের সাথে আরো বেশ কিছু শিক্ষার্থী একজোট হয়ে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা দুপুরের দিকে নার্সিং কলেজের মেইনগেট, একাডেমি ভবন ও প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এছাড়াও প্রশাসনিক কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা ও ক্যাশিয়ার মাহিদুল ইসলামকে অবরুদ্ধ করে রাখে। বিকেল চারটার পর দুই কর্মকর্তাসহ শিক্ষক মুক্ত হন। কলেজের অধ্যক্ষ বলছেন, কলেজে চলা উদ্ভুত পরিস্থিতির বিষয়টি বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক, রামেক হাসপাতালের পরিচালক, রামেকের অধ্যক্ষ, রাজপাড়া থানা পুলিশকে অবহিত করা হয়েছে। এরপর বিকেলে অবরুদ্ধরা মুক্ত হয়েছেন। তবে যারা আন্দোলন করছেন তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মী কর্মী বলে দাবি করেছেন কলেজের শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ঠরা। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এ আন্দোলনকে ইস্যু করে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এদের পেছন থেকে ইন্ধন দিচ্ছে আওয়ামী লীগেরই কিছু ব্যক্তি।
নার্সিং কলেজের শিক্ষকরা বলছেন, একটি পক্ষ শিক্ষার্থীদের ইন্ধন দিয়ে এ আন্দোলন করে নিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ঢাল করে আন্দোলনের মাধ্যমে পানি ঘোলা করে মাছ শিকার চেষ্টা চলানো হচ্ছে। এর পেছনে আওয়ামী লীগের নেতারা শক্তি হয়ে কাজ করছে। কারণ গত ১৫ জানুয়ারী ১৪ জন শিক্ষার্থী ফেল করার পর ১৬ জানুয়ারী অধ্যক্ষের রুমে তালা দেয়ার মধ্যদিয়ে প্রথম এ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন এখন ভিন্ন দিকে মোড় দিয়েছে। যা রীতিমত প্রশ্ন বিদ্ধ। মূলত ফেল করা শিক্ষার্থীরা তাদের বিষয়টি বাদ দিয়ে এখন অধ্যক্ষের অপসরণই মুল উস্যু হিসাবে নিয়েছে। যার কারণে তারা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলছেন। তার অপসরণ দাবি করছেন। শিক্ষকরা বলছেন অধ্যক্ষ অনিয়ম বা দুর্নীতি করলে তার প্রমানসহ শিক্ষার্থীরা কলেজের শিক্ষকদের কাছে আসুক। নয় তো তারা উধ্বর্তন মহলের কাছে যাক। আন্দোলনে কেনো। এ থেকে বোঝা যায় এর পেছনে কেউ কলকাঠি নাড়ছে। যারা আন্দোলনের সাথে জড়িত তারা মূলত নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মী সমর্থক ও নেতা। ৫ আগস্টের পর তারা গোপনীয়তা অবলম্বন করলেও এখন নার্সিং কলেজের আন্দোলনের ইস্যু নিয়ে সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের শক্তি।
এদিকে, গত রোববার ও গতকাল সোমবার অধ্যক্ষের অপসরণের দাবি তোলা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলা হয়। অধ্যক্ষের অনিয়ম ও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমান চাওয়া হলে তারা কোনো প্রমান দিতে পারেনি। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ তুললেও তাদের কাছে কোনো প্রমান নেই। বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কি ধরনের অভিযোগ রয়েছে, সেটি শিক্ষার্থীদের কাছে চাইলে তারা দিতে পারেনি। এমন কি রামেক হাসপাতালের পরিচালক অধ্যক্ষকে অপসরণের বিষয়টি নিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগোনোর কথা বললেও তারা সেটি শোনেনি। যার কারণে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন এখন রাজনৈতিকতায় রুপ নিয়েছে বলে শিক্ষকরা মনে করছেন।
অপরদিকে ফেল করা ১৪ শিক্ষার্থী গত ১৬ জানুয়ারী, গত রোববার (১৯জানুয়ারী) ও গতকাল সোমবার অধ্যক্ষের রুমে তালা ঝুলানো শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। আন্দোলন চলাকালীন সময় ছবি ভাইরাল হওয়ার পর তাদের আন্দোলনের বিষয়বস্তু স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ভাইরাল হওয়া ছবিতে দেখা যায়, যে ১৪জন শিক্ষার্থী ফেল করেছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সদস্য। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন অমি ও সহসভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান সাগরের সাথে আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ছবি তুলেছেন। এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে ফেল করা রাজশাহী নার্সিং কলেজের জহিরুল ইসলাম, আতিকুর রহমান, সোয়েব আকতার শিমু, আব্দুল্লাহ আল কাফি রয়েছে। এরা চারজনই নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নার্সিং কলেজ শাখা সদস্য। এছাড়াও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ রাজশাহী নার্সিং কলেজ শাখার নেতা তায়েবুল ইসলাম, তানজিদ হাসান, মিজানুর রহমান, ইকবাল মাহমুদ, জহিরুল ইসলাম, আহসান হাবিব ইমন, রাশেদুল ইসলাম, আকতারসহ বেশ কয়েকজন রয়েছে যারা আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিশেষ করে আন্দোলনকারীরা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান সাগরের অনুসারি। সাগরের সাথেও বেশ কিছু ছবি ভাইরাল হয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন অমির সাথে বেশ কয়েকজনের ছবি ভাইরাল হয়েছে।
ভাইরাল হওয়া ছবিতে দেখা যায়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই মুজিব নগর দিবসের জনসভা সফল করার লক্ষ্যে একটি ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মাথায় নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কাপড় বাঁধা রয়েছে। আবার কাউকে দেখা যায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির সাথে পোজ দিয়ে ছবি তুলেছেন। আবার কয়েকজন শেখ মুজিবের মুরালের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন। এসব ছবি ভাইরাল হওয়ার পর থেকে আন্দোলনে যোগ দেয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। মুলত আন্দোলকারীদের প্রধান সারিতে থাকা সব শিক্ষার্থী নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য। শিক্ষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের কিছু নেতারা তাদের ইন্ধন দিয়ে কলেজে এমন নৈরাজ্য পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। অধ্যক্ষের অপসরণ মূল বিষয় নয়, মূল বিষয় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা। এছাড়াও অধ্যক্ষকে তারা আওয়ামী লীগের দোসর হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে অধ্যক্ষ জামায়াতের একজন সক্রিয় সদস্য। অথচ আওয়ামী লীগের ট্যাগ লাগিয়ে অধ্যক্ষকে হেনস্তা করা ও পদত্যাগের দাবি করা হচ্ছে। আর এই দাবি যারা করছে তারা নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মী এবং সমর্থক।
আন্দোলনে যোগ দেয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই বলছেন, তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলনে সামিল করা হয়েছে। শিক্ষার্থী অভিযোগ, রোববার আন্দোলন করার পর রাতে হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীদের জানানো হয় সোমবারের আন্দোলনে যেতে হবে। আন্দোলনে না গেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মেয়েদের সাথে র্যাগিং করা হবে। যার কারণে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ভয়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার সর্তে শিক্ষার্থীরা বলেন, যারা ফেল করেছে বা আন্দোলনের প্রধান সারিতে রয়েছে সেসব শিক্ষার্থীরা নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনৈতির সাথে যুক্ত। স্বৈরাচার হাসিনা সরকার পতনের পর তাদের অনেকেই কলেজে আসতো না। যার কারণে পড়াশোনা করতে পারেনি তারা। এ কারণে তারা ফেল করেছে। আর ফেল করার পর তারা আন্দোলন শুরু করেছে। ফেল করার বিষয়ে আন্দোলন করলে দৃষ্টিকটু দেখায়। যার কারণে তারা অধ্যক্ষের অপসরণ দাবিতে আন্দোলন করছেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হয় রাজশাহী নার্সিং কলেজের অধ্যক্ষ ফয়েজুর রহমানের সাথে। তিনি বলেন গত ১৫ জানুয়ারী ফলাফল ঘোষণা ১৬ জানুয়ারী, এরপর গত রোববার (১৯জানুয়ারী) ও গতকাল সোমবার শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবন ও অধ্যক্ষের রুমে তালা ঝুলিয়ে দেয়। গতকাল সোমবার তারা শিক্ষকসহ দুই কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। তিনি বলেন, পরীক্ষার খাতা তো আর কলেজের শিক্ষকরা দেখে না। তারা ফেল করেছে, বিষয়টি আমারও খারাপ লেগেছে। ফেল করা শিক্ষার্থীদের সামনে আরো ভাল প্রস্তুতি নিয়ে পড়াশোনা করা দরকার। কিন্তু আমার কলেজের শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছেন। এটা দু:খ জনক। তিনি বলেন বিষয়টি রাজপাড়া থানা পুলিশকে জানানো হলে অপ্রিকর ঘটনা এড়াতে কলেজে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পরে পুলিশ অবরুদ্ধদের উদ্ধার করে।
উল্লেখ্য, রামেবির অধিভুক্ত নার্সিং কলেজের ৩য় বর্ষে বিএসসি ইন নার্সিং চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল গত ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়। এতে ১২৫১ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ৯০৮ জন শিক্ষার্থী পাস করেছে। এরমধ্যে রাজশাহী নার্সিং কলেজের ১৪ জন শিক্ষার্থী কমিউনিটি হেলথ্ বিষয়ে ফেল করেছে। ফেল করা শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ফলাফল প্রকাশের পর ১৬ জানুয়ারী অধ্যক্ষের রুমে তালা দেয়। পরে গত ১৯ জানুয়ারী আবারো অধ্যক্ষের রুমে তালা দেয়। গতকাল সোমবার তারা পুনরায় অধ্যক্ষের অপসরণ দাবি করে বিক্ষোভ ও প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে দুইজন কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে।