আমনের ভরা মৌসুম চলছে। নতুন ধানের চাল পুরোদমে বাজারে আসছে। কিন্তু দাম কমেনি, বরং বেড়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার আশা করেছিল, আমন উঠলে চালের দাম কমবে।
বেশি বেড়েছে মোটা চালের দাম। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, মোটা চালের দাম বেড়েছে মূলত সর্বশেষ এক সপ্তাহে-কেজিতে তিন থেকে চার টাকা। এ সময়ে মাঝারি চালের দাম বেড়েছে কেজিতে দুই টাকা। সরু চালের দাম এক সপ্তাহে বাড়েনি। কিন্ত এক মাসের হিসাবে বেড়েছে দুই থেকে চার টাকা।
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার গত ১৪ নভেম্বর আশা প্রকাশ করেছিলেন, আমন ধান বাজারে এলে চালের দাম আস্তে আস্তে কমবে। যদিও নওগাঁ চাল ব্যবসায়ী রিরা ট্রেডার্সের মালিক আনোয়ার হোসেন গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণত মৌসুমের সময় ধানের আমদানি বেশি থাকে। ফলে চালের দাম কমে যায়। কিন্তু এবার উল্টো পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। আমনের ভরা মৌসুম চলছে, এরপরও ধানের দাম কমার নাম নেই। উল্টো বেড়ে যাচ্ছে।’
জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। নতুন সরকার চালের দাম কমাতে আমদানি শুল্ক অনেকটাই কমিয়েছে। সরকারিভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে আসেনি। কারণ, আমদানি ততটা হয়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত ১ জুলাই থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত ১ লাখ ১৭ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। যদিও খাদ্য অধিদপ্তর থেকে গত অক্টোবরে ১০ টন চাল আমদানির প্রয়োজনীয়তার কথা সরকারকে জানানো হয়েছিল।
বেসরকারি খাতে যথেষ্ট পরিমাণ চাল আমদানি না হওয়ার কারণ মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাল আমদানিতে খরচ বেশি পড়ছে। সরকার নিজস্ব উদ্যোগে ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকে চাল আমদানির চেষ্টা করছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আমরা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল কেনার কাজ শুরু করেছি। ভারত থেকে চাল আসা শুরু হয়েছে। মিয়ানমার ও ভিয়েতনামের সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আর পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা আলোচনা শুরু করেছি। সরকারিভাবে আমরা মোট ৯ লাখ টন চাল কেনার উদ্যোগ নিয়েছি।
এদিকে গতকাল পাকিস্তানের সঙ্গে চাল আমদানি নিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন আতপ চাল আমদানির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তান থেকে আমদানিতে চালের দাম ধরা হয়েছে টনপ্রতি ৪৯৯ মার্কিন ডলার (কেজি ৬১ টাকার মতো)। ট্রেডিং করপোরেশন অব পাকিস্তান (টিসিপি) ওই চাল সরবরাহ করবে। আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে চালান বাংলাদেশে পৌঁছানোর কথা।
অনলাইনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশে পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফসহ দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যোগ দেন।
ঢাকায় দাম কত
চালের দাম কয়েক বছর ধরেই চড়া। সেটা আরও বেড়েছে। টিসিবির হিসাবে, মোটা চালের কেজি এখন ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা; যা এক বছর আগে ছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। একইভাবে মাঝারি চালের দাম এখন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। এক বছর আগে ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। সরু চালের কেজি ৭০ থেকে ৮৪ টাকা; যা এক বছর আগে ছিল ৬০ থেকে ৭৫ টাকা।
আরেকটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ২০২০ সালের শুরুতে মোটা কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা (টিসিবি)। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকার চালের দাম যেমন নিয়ন্ত্রণ করতে পাে তেমনি সার, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম দ দফায় বাড়িয়ে উৎপাদন খরচও বাড়িয়ে দিয়েছে।
চালের বাড়তি দামের বিষয়ে জানতে চ রাজধানীর মিরপুরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠা কর্মী মো. শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে সবজি ছাড়া অন্য নিত্যপণ্যের দাম আমনের ভরা মৌসুমেও কেন চালের দাম বান সেটাই বুঝে আসছে না।
স্বল্প আয়ের মানুষ মূলত মোটা ও মাঝারি মা চাল কেনে। সরু চালের ক্রেতা মধ্যবিত্ত সে নিম্নবিত্তের পরিবারগুলো বলছে, এখন এক কেজি কিনতে ৬০ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। ঢাকার কার বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও শেওড়া বাজার ঘুরে দেখা গেল, বেশি উৎপাদন ও বিক্রি বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চাল ৬২ থেকে ৬৫ টি বিক্রি হচ্ছে।
মোটা চালের মধ্যে বেশি বিক্রি হয় গুটি ও যার কেজি ৫৫ টাকার আশপাশে। বড় বাজারে এর দামে চাল পাওয়া কঠিন। তবে দরিদ্র মানুষেরা বাজারে যান, সেখানে ৫০ টাকা কেজি দরে চাল প যায়। সেগুলো মূলত সরকারিভাবে দেওয়া রেশ অন্যান্য কর্মসূচির চাল। বিক্রেতারা বলছেন, নানা এসব চাল বাজারে আসে।
মধ্যম আয়ের মানুষ বেশি কেনেন মিনিকেট ৭০ টাকা কেজির নিচে মিনিকেট চাল পাওয়া ক ভালো মানের মিনিকেট বিক্রি হয় ৭৫ টাকা বা এর দামে। নাজিরশাইল চালের কেজি ৮০ থেকে ৯০ ট
নাজিরশাইল চালের মৌসুম এখন। এরপরও চড়া কেন, মৌসুমের সময় সার্বিকভাবে চালের কমল না কেন, জানতে চাইলে নওগাঁ চালকল মা গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ চকদার আলোকে বলেন, ধানের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত আমদানি করা গেলে চালের দাম কমতে পারে।
সরকারি বিতরণ কত
বাজার নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে সরকারি খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল বিক্রি করা আবার সরকার নানা কর্মসূচির আওতায়
সরবরাহ করে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে যাচ্ছে, গত ১ জুলাই থেকে ২৬ ডিসেম্বর সরকারিভাবে প্রায় ১১ লাখ ৯৫ হাজার টন বিতরণ করা হয়েছে, যা আগের বছরের মোট একই সময়ের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি। অর্থনীতিবিদেরা পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও চাল সরবরাহের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
সরকার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তি পরিমাণে
সরবরাহ করতে পারেনি, কারণ মজুত অভ্যন্তরীণ সংগ্রহও বেশি নয়। খাদ্য মন্ত্রণাল হিসাবে, সরকারের কাছে চালের মজুত এখন লাখ টন। চলতি আমন মৌসুমে সরকার সাড়ে লাখ টন চাল ও তিন লাখ টন ধান সংগ্রহের ঠিক করা হয়েছিল গত নভেম্বরের মাঝামাঝি এখন পর্যন্ত সংগ্রহ করা গেছে প্রায় আড়াই লাখা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে সংগ্রহ কাম চলবে। তবে কতটা সফল হওয়া যাবে, তা নিম্নে আছে। কারণ বাজারে চালের দাম বেশি। সর সংগ্রহমূল্য সে তুলনায় কম-কেজি ৪৭ টাকা।
চালকলের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ
অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এইচ আর খান পাঠান প্রথম আলোকে বলেন, ধান ও চালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। যে কারণে সরকারি গুদামে চাল সরব্বাহের গতি হয়তো কিছুটা ধীর। তবে বেশির ভাগ চালকলমালিক সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে চাল সরবরাহ করবেন।
অবশ্য অতীতে দেখা গেছে, বাজারে বেশি দাম পাওয়া গেলে সরকারি গুদামে চাল দেননি মিলমালিকেরা।
বিশ্ববাজার পরিস্থিতি
চালকে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। অতীতে দাম বাড়লে চাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হতো। ডলারের দাম কম থাকায় আমদানি করা লাভজনক থাকত ব্যবসায়ীদের কাছে। কিন্তু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চাল আমদানি করতে খরচ অনেক বেশি পড়ছে।
বিশ্ববাজারে চালের দাম টনপ্রতি সাধারণত ৪০০ থেকে ৫০০ ডলারের মধ্যে থাকে। কখনো কখনো বেড়ে যায়। ২০২২ সালের শুরুতে ৮৬ টাকা ডলারে টনপ্রতি ৫০০ ডলার মূল্যের এই চাল আমদানি করলে খরচ পড়ত কেজিতে ৪৩ টাকা (জাহাজভাড়া ও অন্যান্য খরচ ছাড়া)। এখন দাম একই থাকলেও কেজি পড়বে ৫৬ টাকার বেশি। কারণ, ডলার এখন ১২৩ টাকা হয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ভিয়েতনামে ৫ শতাংশ ভাঙা চালের টনপ্রতি দর ২০২৪ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ছিল ৬০৮ ডলার। এখন তা কমে ৪৯৬ ডলারে নেমেছে। ওই দামে আমদানি করলে প্রতি কেজির দাম পড়বে জাহাজভাড়া ও অন্যান্য খরচ ছাড়া ৬১ টাকার মতো। থাইল্যান্ডেও চালের দাম কমেছে। কিন্তু এরপরও বেসরকারিভাবে আমদানি লাভজনক নয়।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের চালের বাজার বড় ধরনের সুরক্ষা পেয়ে গেছে। এখন সরকারিভাবে আমদানি বাড়িয়ে সরবরাহ বাড়ানো এবং উৎপাদন বাড়িয়ে দাম কমানো ছাড়া অন্য বিকল্প নেই।
চালের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানাচ্ছে, ডিসেম্বর মাসেও দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ শতাংশের কাছাকাছি, যা নভেম্বর মাসের তুলনায় সামান্য কম। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় মূল্যস্ফীতির হার এখনো চড়া।
বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ধারণা করা যায়, এবার বন্যা ও অন্য কারণে আমনের উৎপাদন আশানুরূপ হয়নি। সরকারের কাছেও মজুত কম। এ কারণে বাড়তি দামের আশায় ব্যবসায়ী ও বড় কৃষকেরা চাল বাজারে ছাড়ার বদলে মজুত করছেন। চালের বাজার স্থিতিশীল রাখা না গেলে আগামী দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতির ওপর তা আরও প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, এখন সরকারের উচিত অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সংগ্রহ অথবা আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের দিকে না তাকিয়ে নিজে বড় উদ্যোগ নিয়ে আমদানি বাড়ানো।