মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা দিন ও রাতের পার্থক্য তৈরি করেছেন। দিনকে করেছেন মানুষের পরিশ্রমের উপযোগী আর রাতকে করেছেন আরামের উপযোগী। তবে দিন আর রাতে রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলার নির্দিষ্ট কিছু বিধান মানার আদেশ দিয়েছেন তিনি। এর বাইরে পুরো সময়টা মানুষের জীবন-জীবিকা উপার্জনের জন্য নির্ধারিত।
উল্লেখ্য, হালালপন্থায় মানুষের যেকোনো ধরনের কাজ ইসলাম সমর্থন করে। তবে কাজের আগে নিয়মিত আল্লাহ তাআলার বিধান পালনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনুল কারিমে বলেন, فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيراً لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থ: ‘অতপর নামাজ শেষ হলে তোমরা জমিনে (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা (জীবিকা উপার্জনে) সফলকাম হও’। (সূরা: জুমা, আয়াত: ১০)
দিন ও রাতে ফরজ ইবাদত পালনের পাশাপাশি নফল ইবাদতের প্রতিও উৎসাহি করে তোলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বিশ্বনবী রাসূলুল্লহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘হে বস্ত্রাবৃত! রাতে নামাজে দাঁড়ান, কিছু অংশ ছাড়া, রাতের অর্ধেক কিংবা তার চেয়ে কিছুটা কম। অথবা তার চেয়ে বাড়াও আর ধীরে ধীরে সুস্পষ্টভাবে কোরআন পাঠ করো’। (সূরা: মুজ্জাম্মিল, আয়াত, ১-৪)
আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় হাবিব রাসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ করে রাতের বেলা নামাজ পড়তে বললেও একে ফরজ করে দেওয়া হয়নি, বরং নফল হিসেবে রাখা হয়েছে। তবে কেউ যদি রাতের বেলা বিছানা ছেড়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতে পারে, তার জন্য রয়েছে বিশেষ পুরস্কার।
পবিত্র কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় করো তোমার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে। আশা করা যায়, তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন’। (সূরা বনি ইসরাঈল, (১৭), আয়াত, ৭৯)
রাতের ইবাদত শুধু তাহাজ্জুদ ও কোরআন তেলাওয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাহাজ্জুদ, তেলাওয়াতের পাশাপাশি কিছু সময় আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করাও অনেক সওয়াবের। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং রাতের একাংশেও তুমি তার তাসবিহ পাঠ করো এবং নামাজের পশ্চাতেও’। (সূরা: কাফ, আয়াত: ৪০)
রাতের বেলা জেগে জেগে ইবাদত করার রয়েছে বিশেষ ফজিলত। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাদের রব আল্লাহ তাআলা প্রতি রাতে যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে, তখন প্রথম আসমানে নেমে এসে বলতে থাকেন, কে আমাকে ডাকবে যে আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে আমার কাছে চাইবে যে আমি তাকে দেব? কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে যে আমি তাকে ক্ষমা করে দেব? (বুখারি, হাদিস, ১১৪৫)
রাত জেগে ইবাদতের সহজ পদ্ধতি
অনেকেই রাত জেগে ইবাদতের চিন্তা করেন কিন্তু পারির্শ্বিক বিভিন্ন কারণে হয়ে উঠে না। এখানে রাত জেগে ইবাদতের কয়েকটি পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
সারা রাত জেগে ইবাদত করা
সারা রাত জেগে ইবাদত করা আল্লাহ তাআলার বিশেষ বান্দাদের গুণ। রাত জেগে তারা আত্মার প্রশান্তি লাভ করেন। অধিক রাত জাগরণের কারণে তারা ক্লান্ত হন না, রাতে নির্বিঘ্নে ইবাদতের পরিবেশ পেতে তারা দিনের বেলা ঘুমিয়ে নেন। প্রথম যুগের বুজুর্গ আলেমদের কেউ কেউ এভাবে সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন। তাদের কেউ কেউ এশার ওজুতে ফজর নামাজ পড়তেন।
আবু তালেব মক্কী বর্ণনা করেছেন, ৪০ জন তাবেয়ি এমন ছিলেন যারা সারা জেগে ইবাদত করতেন। তাদের কয়েকজন এমন ছিলেন যে টানা ৪০ বছর এই আমল অব্যহতভাবে করে গেছেন।
অর্ধেক রাত জেগে ইবাদত
পূর্ববর্তী যুগের বুজুর্গ আলেমদের মধ্যে এমন ইবাদতকারীর অসংখ্য ছিল। এক্ষেত্রে উত্তম হলো রাতের এক তৃতীয়াংশ ও শেষ এক ষষ্ঠাংশ ঘুমিয়ে অতিবাহিত করা।যেন ইবাদত ও জাগরণ মধ্যস্থলে হয়।
রাতের এক তৃতীয়াংশ জেগে ইবাদত করা
এভাবে যারা ইবাদত করার ইচ্ছা করেন, তাদের জন্য রাতের প্রথমার্ধ এবং এক ষষ্ঠাংশ ঘুমিয়ে কাটানো উত্তম। রাতের শেষ ভাগে কিছুটা ঘুমিয়ে নিলে ফজর নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। এতে করে ফজরের সময় তন্দ্রা আসে না। এছাড়া রাতের শেষ অংশের ঘুমের কারণে চেহারায় রাত জাগার ছাপ পড়ে না।
রাতের এক ষষ্ঠাংশ বা এক পঞ্চমাংশ জেগে ইবাদত করা
এক ষষ্ঠাংশ বা এক পঞ্চমাংশ জেগে ইবাদত করেন তাদের জন্য উত্তম হলো রাতের শেষার্ধে জাগা। এর আগে ঘুমিয়ে নেওয়া।
রাতে জেগে ইবাদতের জন্য কোনো সময় নির্ধারণ না করা
অনেকে রাত জেগে ইবাদত করতে চান। তবে রাত জাগার জন্য তাদের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। এমন ব্যক্তিদের জন্য প্রথম রাতে ঘুম আসা পর্যন্ত জাগ্রত থাকা এবং এরপর যখন ঘুম ভাঙবে তখন উঠে ইবাদত করা শ্রেয়। আবার প্রবল ঘুম এলে ঘুমিয়ে পড়বেন। এই অবস্থায় এক রাতে দুইবার ঘুমানো ও দুইবার জাগা হবে। এভাবে রাত জেগে ইবাদত করা উত্তম। রাসূলুল্লাহ (সা.) এভাবে ইবাদতের জন্য রাত জাগতেন। হজরত ইবনে ওমর ও অন্যান্য সাহাবিরাও এভাবে রাত জাগতেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জাগরণ পরিমাণের দিক থেকে সবসময় একই রকম ছিল না। তিনি কখনো অর্ধেক রাত জাগতেন, কখনো রাতের এক তৃতীয়াংশ, কখনো দুই তৃতীয়াংশ এবং কখনো এক ষষ্ঠাংশ জাগতেন। সূরা মুযযাম্মিলের এক আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাত জাগার বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে, اِنَّ رَبَّکَ یَعۡلَمُ اَنَّکَ تَقُوۡمُ اَدۡنٰی مِنۡ ثُلُثَیِ الَّیۡلِ وَنِصۡفَہٗ وَثُلُثَہٗ وَطَآئِفَۃٌ مِّنَ الَّذِیۡنَ مَعَکَ ؕ وَاللّٰہُ یُقَدِّرُ الَّیۡلَ وَالنَّہَارَ
অর্থ: ‘নিশ্চয় তোমার রব জানেন যে, তুমি রাতের দুই তৃতীয়াংশের কিছু কম, অথবা অর্ধরাত অথবা রাতের এক তৃতীয়াংশ সালাতে দাঁড়িয়ে থাক এবং তোমার সঙ্গে যারা আছে তাদের মধ্য থেকে একটি দলও। আর আল্লাহ রাত ও দিন নিরূপণ করেন’। (সূরা মুযযাম্মিল, (৭৩), আয়াত, ২০)
শুধু তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য জাগা
পুরো রাত বা রাতের অর্ধেক অংশ না জেগে শুধু চার রাকাত বা দুই রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার পরিমাণ সময়ের জন্য রাত জাগা। এটাই রাত জাগরণের সর্বনিম্ন পরিমাণ। রাত জেগে নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে কারো কাছে ওজু করা কঠিন মনে হলে তিনি অল্প কিছু সময় জিকির আজকার করে নিতে পারেন।
যাদের জন্য রাত জেগে ইবাদত কঠিন
যদি মাঝ রাতে ওঠা কঠিন হয় তাহলে মাগরিব ও এশার মাঝের সময় এবং এশার পরবর্তী সময়কে ইবাদতের জন্য কাজে লাগানো উচিত। এ সময় নফল নামাজ, জিকির, আজকারে কাটানো উচিত। এমন ব্যক্তি রাতে ইবাদতের জন্য জাগতে পারেন না, তবে তার জন্য সুবহে সাদিকের আগে উঠা এবং ফজর নামাজ জামাতে আদায় করা জরুরি। এভাবে রাতের উভয় প্রান্তে জাগরণ ও ইবাদতের ফজিলত পাওয়া যাবে।
উসমান ইবনু আফফান রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এশার নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে তার জন্য অর্ধরাত (নফল) নামাজ আদায়ের সওয়াব রয়েছে। যে ব্যক্তি এশা ও ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে তার জন্য সারা রাত (নফল) নামাজ আদায়ের সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে’। (তিরমিজি হাদিস: ২২১)