ভক্তদের কাছে তিনি গুরু। অনেকের কাছে তিনি নগর বাউল। তার ভারী কণ্ঠে মাতোয়ারা সব বয়সের সংগীতপ্রেমীরা। তার কনসার্ট মানে আলাদা এক উদ্দীপনা, প্রাণোচ্ছ্বলতা। কথা ও সুরের এক অনন্য মিশেল। বাংলা রক মিউজিকে তার আগমন আলোর ঝলকানির মতো। ‘ফিলিংস’ হয়ে ‘নগর বাউল’, যে গালিচায় উড়ে বেড়িয়েছেন, ছড়িয়েছেন দোর্দণ্ড প্রতাপ। তার অসংখ্য গানে উন্মত্ত হয়ে হাওয়ায় ভেসেছে লাখো লাখো শ্রোতা। সুবাস ছড়িয়েছেন কখনও মহুয়া ফুলের মতো, কখনও বা মঞ্চে ধরা দিয়েছেন বিদ্যুচ্চমকের মতো। তার গাওয়া ‘বিজলি’ গানের মতো করে বলি– চোখের দেখাই যদি মনে রয়, ভালোবেসে আমরা তাকে কী বলব? আমরা তাকে বলব, ‘বাংলার রকস্টার’। অনেকের মতে, বাংলা গানের সত্যিকারের সুপারস্টার তিনি। তার নাম ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস।
জেমসের জীবন বেশ বাঁক বদলের, অনেক গল্পের। তবে স্বপ্নের জলাঞ্জলি দিতে নারাজ ছিলেন তিনি। তাই গানের জন্য ছেড়ে দেন ঘরই। জন্মস্থান নওগাঁ ছেড়ে গিয়ে ওঠেন চট্টগ্রামের আজিজ বোর্ডিংয়ে। সেখানেই তার গানের জগৎ প্রসারিত হয়। হয়ে ওঠেন নগর বাউল। ১৯৮০ সালের দিকে চট্টগ্রামে এই ব্যান্ড গড়েন তিনি।
সেই আশির দশক থেকে শুরু জেমসের পথচলা। তখনকার আর বর্তমান শহরের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। গান শোনার মাধ্যমও বদলে গেছে। ক্যাসেট থেকে সিডি, সিডি থেকে এমপি থ্রি। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও ডিজিটাল বাংলাদেশের নতুন যুগে ঢাকার একেকজন তরুণ যেন বিশ্বনাগরিক। বলিউড, হলিউড, আরজিৎ সিং, মেরুন ফাইভ, লিম্প বিজকিট, নেটফ্লিক্স— বিশ্বের সব সাংস্কৃতিক পণ্য এখন মুঠোফোন, এমপি থ্রি প্লেয়ার অথবা ল্যাপটপে, ক্লিকের নাগালে। কিন্তু গানের গুরু বদলাননি। তিনি একজনই—জেমস।
আজ (০২ অক্টোবর) ব্যান্ড জগতের ‘রকস্টার’ নগর বাউল জেমসের জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের আজকের এই দিনেই পৃথিবীতে এসেছিলেন তিনি। জীবনের ৫৯ বসন্ত পেরিয়ে ৬০ বছরে পা দিলেন এই গায়ক। তার পুরো নাম ফারুক মাহফুজ আনাম হলেও ভক্তদের কাছে নগর বাউল জেমস নামেই পরিচিত তিনি।
২০১৫ সালে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ১০টি বিলবোর্ড টাঙিয়ে প্রিয় ব্যান্ড তারকা জেমসকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের ছেলে প্রিন্স। জানা যায়, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে জেমসের জন্মদিনে ভিন্ন কিছুর আয়োজন করেন ওই ভক্ত। ২০১৪ সালেও তিনি জেমসের জন্মদিনে বিশাল এক কেক নিয়ে ঘুরে বেড়ান ঢাকা শহরের নানা জায়গায়।
এরপর ২০১৭ সালের জন্মদিনে পুরো অক্টোবর জুড়ে সারা দেশে এক কোটি গাছ লাগান জেমসের ভক্তরা। এ ছাড়া সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় জেমসের ৫৩টি প্রতিকৃতিও টাঙানো হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালেও নানা আয়োজনে জেমসের জন্মদিন পালন করেন তার পাগল ভক্তরা।
কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে পাল্টে যায় চিত্র। কারণ তার আগের বছরের ১৮ অক্টোবর না ফেরার দেশে চলে যান বাংলা ব্যান্ড জগতের আরেক কিংবদন্তি ও গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু। জেমস এবং আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বন্ধুর মৃত্যুতে জেমস এতটাই কষ্ট পেয়েছিলেন যে, ২০১৮ সালে একটি লাইভ কনসার্টে তাকে অঝোরে কাঁদতে দেখা যায়।
পরের বছর জন্মদিন আসার আগেই জেমস ঘোষণা দেন যে, তিনি জন্মদিনের কোনো উৎসব পালন করবেন না। পাশাপাশি ভক্তদেরও অনুরোধ করেন কোনো ধরনের আয়োজন না করতে। যার কারণে ২০১৯ সালের পর থেকে ভক্তদের পক্ষ থেকে জেমসের জন্মদিনের আর কোনো আয়োজন করা হয়নি। যথারীতি কোনো আয়োজন নেই এ বছরও।
১৯৮০ সালে জেমস প্রতিষ্ঠা করেন ব্যান্ড ‘ফিলিংস’। ১৯৮৭ সালে প্রথম অ্যালবাম ‘স্টেশন রোড’ প্রকাশ পায়। ১৯৮৮ সালে ‘অনন্যা’ নামের একক অ্যালবাম প্রকাশ করে সুপারহিট হয়ে যান জেমস। এরপর ১৯৯০ সালে ‘জেল থেকে বলছি’, ১৯৯৬ সালে ‘নগর বাউল’, ১৯৯৮ সালে ‘লেইস ফিতা লেইস’, ১৯৯৯ সালে ‘কালেকশন অব ফিলিংস’ অ্যালবামগুলো প্রকাশ পায়। এরপর ‘ফিলিংস’ ভেঙে জেমস গড়ে তোলেন নতুন লাইনআপে ব্যান্ড ‘নগর বাউল’।
২০০০ সালের প্রথম দিকে পেপসির একটি বিজ্ঞাপন চিত্রে অংশগ্রহণ করেন জেমস। এটিই ছিল তার কাজ করা প্রথম বিজ্ঞাপন চিত্র। বিজ্ঞাপনটি বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রচার করা হয়। এরপর তিনি ২০১১ সালে এনার্জি ড্রিংক ব্ল্যাক হর্সের বিজ্ঞাপনে কাজ করেন।
চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেও সফল হয়েছেন নগর বাউল। তার বেশকিছু গান ‘সত্তা’, ‘দেশা দ্য লিডার’ ছবির জন্য গান করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। বাংলা গানের পাশাপাশি হিন্দি গানে কণ্ঠ দিয়েও জয় করেছেন কোটি ভক্ত-শ্রোতার হৃদয়।
বলিউডে তার গাওয়া ‘ভিগি ভিগি’ (গ্যাংস্টার সিনেমা), ‘চাল চালে’ (ও লামহে) এবং ‘আলবিদা’, ‘রিস্তে’ (লাইফ ইন অ্যা মেট্টো), ‘বেবাসি’ (ওয়ার্নিং) গানগুলো উল্লেখযোগ্য। একটা প্রজন্মের কাছে জেমস মানে এখনো এক উন্মাদনা, তার প্রতি ভক্তদের ভালোবাসা এতোটাই প্রবল যে ভক্তদের তিনি ‘দুষ্টু ছেলের দল’ বলে অ্যাখ্যায়িত করেন। তার প্রকাশ পাওয়া সবশেষ গান ‘সবই ভুল’। ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরের চাঁদ রাতে এটি প্রকাশ পায়।
গ্রন্থনা: মাহমুদুল হাসান ইমন