
গত এক যুগে, প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনেছে, রেলওয়ে। বছর-বছর আয়ের হিসাব থাকলেও; ব্যয়ের সঠিক হিসাব নিয়ে মুখ খুলতে চান না কর্মকর্তারা। অভিযোগ-দুর্নীতি আর অনিয়মের মাধ্যমে দেয়া বেসরকারি খাতের ৩৭ ট্রেনের ৩২টিই পরিচালনা করছে, সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা। লোকসান কমাতে, খাতওয়ারি আয়-ব্যয়ের হিসাব নির্দিষ্ট করার উপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অপরদিকে, আয় বাড়াতে নতুন খাত সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি।

লোকসান আর রেল যেন মুদ্রার এপিট-ওপিঠ। বিনিয়োগ হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা, বেড়েছে টিকিটের মূল্য। কিন্তু তারপরও লাভের স্টেশনে ভিড়তে পরেনি জনপ্রিয় এই গণপরিবহন। লাভের আশায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে ৩৭টি ট্রেন। কিন্তু তাতেও গুরুতর অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি।
বেসরকারি ট্রেনগুলোর মধ্যে ৩২টি ট্রেনই পরিচালনা করছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সালাউদ্দিন রিপন ও তার স্ত্রী। অভিযোগ আছে, সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ও নুরুল ইসলাম সুজনের কল্যানে রেলের সাথে অসম চুক্তি বহাল রাখতে সমর্থ্য হয়েছেন তারা। ট্রেন চলে বেসরকারি খাতে অথচ জ্বালানি-মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ সব খরচই বহন করে রেল কর্তৃপক্ষ। শুধু প্রতি ট্রিপে কোচপ্রতি নির্ধারিত টাকা দেবে ইজারাদা। এ বিষয়ে জানতে সালাউদ্দিন রিপনকে ফোন করা হলেও কোন সাড়া মেলেনি।
নানা সমালোচনার পর চলতি সপ্তাহে বেসরকারি খাতে পরিচালিত ২৪টি ট্রেনের ইজারা ডিসেম্বর থেকে বাতিল করে নতুন দরপত্র আহবান করার কথা জানায় রেল মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে কথা বললেও রিপন-লুনা দম্পত্তি ও এ খাতের ব্যয়ের হিসাবের ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি রেল কর্তৃপক্ষ।
রেল মহাপরিচালক সরদার শাহাদাত আলী বলেছেন, আসলে লিজকৃত ট্রেনের যে বিষয়টি, সেটি নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে নতুনভাবে টেন্ডার দেয়া হয়েছে। যেহেতু, ট্রেনের কার্যক্রম পূর্বাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চল থেকে দেয়া হয়, তাই ওই জোনে মন্ত্রণালয় নির্দেশনা পাঠিয়েছে। আশা করছি, দ্রুত কার্যক্রম শুরু হবে।
বিগত সরকারের সবশেষ রেল মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ব্যয়ের হিসাব দিতে না পারায় ক্ষোভ জানান কমিটির সদস্যরা। সেখানে উপস্থাপিত হিসাবে বলা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রী প্রতি খরচ হয়েছে দুই টাকা ৪৩ পয়সা আর আয় হয়েছে ৬২ পয়সা।
পণ্য পরিবহনে, প্রতি কিলোমিটারে টন প্রতি খরচ হয়েছে প্রায় ৯ টাকা। সে হিসাবে প্রতি বছর প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার লোকসান গুনতে হয় রেলকে। রেলওয়েতে দায়িত্ব পালন করা সাবেক এ কর্মকর্তা বলেছেন, খাতওয়ারী ব্যয়ের কোনো হিসাব না রাখায় লোকসানের সঠিক হিসাব মিলছে না।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন বলেছেন, এই ট্রেনগুলোর পেছনে রেলগুলোর ব্যয় এটা কখনোই রেল কর্তৃপক্ষ হিসাব করে না কিংবা হিসাব করার সক্ষমতা আদৌ আছে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। এই ব্যয় হিসাব করতে গেলে অনেক কিছু চলে আসবে। ধরা যাক, যদি গত বছরের ব্যয় হিসাব করতে হয়, তাহলে কতো ক্রয়, নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণসহ অনেককিছু চলে আসে।
রেলকে সহসাই লাভজনক করা কঠিন বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতি কমাতে না পারলে পরিস্থিতির উন্নতির আশা নেই।
মাহবুব কবির মিলন আরও বলেন, লোকসানের পরিমাণ কমিয়ে আনা এবং লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে আনতে হলে, প্রথমত, রেলওয়েকে দুর্নীতির সবরকম ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটি প্রোজেক্টে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সাথে সাথে, পরিবহন আরও বাড়াতে হবে। সারা পৃথিবীতে, রেল সবচেয়ে বেশি আয় করে মাল পরিবহনের মাধ্যমে, যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে নয়।
এদিকে রেল মহাপরিচালক সরদার শাহাদাত আলী বলেন, রেলের মূল সমস্যা ইঞ্জিন। বিশেষকরে, মিটারগেজ ইঞ্জিনে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। যার কারণে, মালবাহী ট্রেনগুলো ভালোভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না।
এছাড়াও, এসবের পাশপাশি রেলে যাত্রী সেবার মান বাড়ানোর পরামর্শও দিয়েছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।