বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাটের মানুষ প্রতিদিন তিস্তা নদীর পানি নিয়ে উদ্বেগে থাকেন। সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি এই উদ্বেগকে আরও তীব্র করেছে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রংপুর অঞ্চলে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, ফলে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে শুধু নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতেই নয় বরং পুরো অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন এবং জীবিকার ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। তিস্তার মতো একটি নদী যা বাংলাদেশের কৃষির প্রাণকেন্দ্র, এখন তা বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে। এই নদী যেন এখন মানুষের জন্য আশীর্বাদের পরিবর্তে অভিশাপ হয়ে উঠেছে।
বন্যার ফলে কৃষকরা বিপুল পরিমাণ ফসল হারাচ্ছেন। তাদের বোরো এবং আমন ফসল তলিয়ে যাচ্ছে যার ফলে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে না বরং কৃষকদের জীবনে এক ধরনের হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে। যেমন, কুড়িগ্রামের কৃষকরা জানাচ্ছেন, তিস্তার পানি দ্রুত বাড়ছে এবং তাদের ক্ষেতের ফসল একের পর এক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা তাদের সামনে এক ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরছে। জীবন ও জীবিকার জন্য সংগ্রাম করা এই মানুষগুলো প্রতিদিনই নতুন করে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই সংকটের মূলে আসলে কি?
ভারত, বাংলাদেশের সাথে এই অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারে একতরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণের মাধ্যমে তারা তিস্তায় পানি প্রত্যাহার করছে যা বাংলাদেশে অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। ভারতের সরকার প্রায়শই বর্ষাকালে হঠাৎ করে পানি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় যার ফলে বাংলাদেশের নদীগুলোতে প্রচণ্ড জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। অথচ, বাংলাদেশ সরকার বারবার ভারত সরকারের কাছে এই বিষয়ে সহানুভূতি ও সমঝোতা কামনা করেছে কিন্তু ফলস্বরূপ দেখা যায় ভারতীয় পক্ষের তরফ থেকে কার্যকরী উদ্যোগ নেই।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) থাকার পরও কেন দুই দেশের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে গেছে? অনেক বছর ধরে ভারতীয় পক্ষ বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনার তথ্য শেয়ার করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। ফলে, বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ড অনেকাংশেই অনুমানের ভিত্তিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। যে কারণে যখনই ভারতের উজানে বৃষ্টিপাত হয় তখন বাংলাদেশের নিচু অঞ্চলগুলোতে হঠাৎ করে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এটি বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য এক বিশাল বিপর্যয়।
তিস্তা নদীর বন্যার ফলে যে দুঃখজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে তার জন্য শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণকে দোষারোপ করা উচিত নয়। বরং, রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব এবং সহযোগিতার অভাবে এই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। দেশের নদীগুলোকে সঠিকভাবে রক্ষা করতে, খনন করা এবং সংরক্ষণ করার কাজ করা জরুরি। তিস্তা নদীকে বাঁচাতে হলে, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বৈজ্ঞানিকভাবে নদী খননের উদ্যোগ নিতে হবে। এটি শুধু নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনবে না বরং বন্যার ঝুঁকিও কমাতে সাহায্য করবে।
এদিকে, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থাগুলি সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। তবুও এই পদক্ষেপগুলি শুধুমাত্র সাময়িক সমাধান হিসেবে কাজ করছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য জরুরি সহায়তা প্রদান, নিরাপদ আশ্রয়স্থল গঠন এবং পুনর্বাসনের পরিকল্পনা দরকার। নদী বাঁচাতে হলে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে তিস্তা নদী এবং এর আশেপাশের জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
এখনও অব্যাহতভাবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের স্বার্থের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সম্পর্ক উন্নয়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশের কৃষকদের দুর্দশা ও নদী রক্ষা করা উভয় দেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য দুই দেশের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান এবং যোগাযোগ বাড়ানো উচিত। এটা কেবল তিস্তা নদীকে রক্ষা করবে না বরং উভয় দেশের জনগণের জীবনযাত্রাও উন্নত করবে।
নদী বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও এই স্লোগানটির গুরুত্ব এখন থেকেই উপলব্ধি করতে হবে। দেশের কৃষকরা যারা এই নদীকে নিজের জীবনের অংশ মনে করেন; তাদের জন্য এই নদী রক্ষার আন্দোলনে আমরা সকলেই একযোগে কাজ করতে হবে। আমাদের উচিত সরকারের কাছে দাবি জানানো যে, তারা বন্যার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং ভারতীয় সরকারের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে।
এখন সময় এসেছে যে, আমরা সবার জন্য নিরাপদ ও স্থিতিশীল একটি ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে কাজ করি। তিস্তা নদী শুধুমাত্র একটি জলস্রোত নয় বরং আমাদের জীবন ও জীবিকার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদী আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের পরিচয়ের অংশ। তাই, নদীকে রক্ষা করতে হবে মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে।
পানির সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক কারণগুলির জন্য আমরা যদি একসাথে কাজ না করি, তাহলে এই সংকট আরও বেড়ে যাবে। আমাদের উচিত একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাতে নদী ও এর তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করা সম্ভব হয়। সরকার, স্থানীয় জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা—এই তিনটি পক্ষ একত্রিত হলে তিস্তা নদীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্ভব।
তিস্তা নদীর সমস্যা সমাধানে আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে এখনই। অভিন্ন নদী তিস্তার পানি ব্যবহারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে যা শুধু তিস্তা নয়, বরং বাংলাদেশের কৃষকদের ভবিষ্যৎকেও সুরক্ষিত করবে। আমাদের নদী, আমাদের ভবিষ্যৎ; আসুন আমরা সবাই একযোগে কাজ করি নদীকে বাঁচানোর জন্য এবং আমাদের দেশকে আরও উন্নত করার জন্য।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়